মিশ্রণ (অষ্টম অধ্যায়)

ষষ্ঠ শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান | NCTB BOOK
2.1k
Summary

দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন রকমের জিনিস ব্যবহার করি, যা বিশুদ্ধ বা মিশ্রণ হতে পারে। মিশ্রণের মধ্যে দ্রবণ, সাসপেনশন, এবং কলয়েড অন্তর্ভুক্ত। এই অধ্যায়ের শেষে আমাদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা থাকবে:

  • মিশ্রণ এবং দ্রবণের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা।
  • বিভিন্ন প্রকার দ্রবণের মধ্যে পার্থক্য করা।
  • পানি এবং কঠিন পদার্থ দিয়ে দ্রবণ প্রস্তুত করা।
  • দ্রবণে তাপমাত্রার প্রভাব ব্যাখ্যা করা।
  • সর্বজনীন দ্রাবক হিসেবে পানির ব্যবহার প্রদর্শন করা।
  • সমসত্ব এবং অসমসত্ব মিশ্রণ প্রস্তুত ও উপাদানসমূহ পৃথক করা।
  • লবণাক্ত পানি থেকে লবণের স্ফটিক এবং বিশুদ্ধ পানি প্রস্তুত করা।
  • দ্রবণ, কলয়েড ও সাসপেনসনের মধ্যে পার্থক্য করা।
  • দৈনন্দিন জীবনে দ্রবণ, কলয়েড এবং সাসপেনসনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা।
  • দ্রবণ ও সাসপেনসনের প্রয়োগ উপলব্ধি করা।
  • পরীক্ষণ কাজের যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার করা।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা রকমের জিনিস ব্যবহার করে থাকি। এদের কোনোটি বিশুদ্ধ আর কোনোটি মিশ্রণ। মিশ্রণের মধ্যে আবার কোনোটি দ্রবণ, কোনোটি সাসপেনসন আর কোনোটি কলয়েড।

এই অধ্যায় শেষে আমরা
• মিশ্রণ এবং দ্রবণের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারব।
• বিভিন্ন প্রকার দ্রবণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারব।
পানি এবং কঠিন পদার্থ দিয়ে বিভিন্ন প্রকার দ্রবণ প্রস্তুত করতে পারব।
• দ্রবণে তাপমাত্রার প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারব।
• সর্বজনীন দ্রাবক হিসেবে পানির ব্যবহার প্রদর্শন করতে পারব।
• সমসত্ব এবং অসমসত্ব মিশ্রণ প্রস্তুত এবং উপাদানসমূহ পৃথক করতে পারব।
• লবণাক্ত পানি হতে লবণের স্ফটিক এবং বিশুদ্ধ পানি প্রস্তুত করতে পারব।
• দ্রবণ, কলয়েড এবং সাসপেনসনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারব।
• দৈনন্দিন জীবনে দ্রবণ, কলয়েড এবং সাসপেনসনের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে পারব।
• আমাদের জীবনে দ্রবণ ও সাসপেনসনের প্রয়োগ উপলব্ধি করব।
• পরীক্ষণ কাজের যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারব।

Content added By

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

উদ্দীপকের আলোকে প্রশ্নের দাও

কক্ষ তাপমাত্রায় NaCO3 এর দ্রবণীয়তা ২০.৬ গ্রাম।

উদ্দীপকটি পড় প্রশ্নের উত্তর দাও

কক্ষ তাপমাত্রায় সোডিয়াম কার্বনেটের দ্রবণীয়তা ২১.৬ গ্রাম।

মিশ্রণ এবং দ্রবণ (পাঠ ১-২)

444

আমরা সকলেই চিনির শরবত ও ঝালমুড়ির সাথে কম বেশি পরিচিত। গ্লাসে বা জগে পানি নিয়ে তাতে কিছু চিনি ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়া দিলেই কিন্তু চিনির শরবত হয়ে যায়। আবার ঝালমুড়ি বানাতে হলে কিছু মুড়ি নিয়ে তাতে চানাচুর, কিছু পেঁয়াজ কুচি, মরিচের কুচি, টোমেটো ইত্যাদি ভালোভাবে মিশাতে হয়। চিনির শরবত ও ঝালমুড়ি উভয় ক্ষেত্রেই কিন্তু একের অধিক উপাদান আছে। এরকম একের অধিক বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে যা পাওয়া যায় তাকেই আমরা মিশ্রণ বলি। এই উপাদানগুলো মিশ্রিত থাকলেও, ক্ষুদ্র স্কেইলে তাদের কাজগুলো পৃথক ভাবেই অবস্থান করে।

কাজ: দ্রবণ বা সমসত্ব মিশ্রণকে জানা। প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১টি পদ্ধতি: কাচের গ্লাসটি ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নাও।
কাচের গ্লাস, চামচ, চিনি ও পানি। গ্লাসের তিন-চতুর্থাংশ পরিমাণ খাওয়ার পানি নাও ও ১ চামচ চিনি যোগ করে নাড়া দাও। এবার চিনির শরবতটিকে কয়েক ভাগে ভাগ কর। প্রতিটি ভাগ থেকে এক চামচ করে খেয়ে দেখ।

চিনিকে আলাদা করে দেখতে পাচ্ছ কি? না, পাচ্ছ না। কারণ, চিনি পানিতে দ্রবীভূত হয়ে গেছে। প্রতিটি ভাগ কি একই রকম মিষ্টি? হ্যাঁ, প্রতিটি ভাগ একই রকম মিষ্টি। কারণ হলো চিনির শরবতে চিনির কণাগুলো পানির সবখানে সুষমভাবে বা সমানভাবে বিন্যস্ত আছে।
চিনির শরবতের মতো যে সমস্ত মিশ্রণে উপাদানগুলো সুষমভাবে বণ্টিত থাকে এবং একটি উপাদান থেকে আরেকটিকে সহজে আলাদা করা যায় না তাদেরকেই দ্রবণ বা সমসত্ব মিশ্রণ বলা হয় অর্থাৎ দ্রবণসমূহ এক বিশেষ ধরনের মিশ্রণ। এখন তোমরা পানিতে লবণ, গ্লুকোজ, ফলের রস যোগ করে দেখ প্রাপ্ত মিশ্রণগুলো সমসত্ব মিশ্রণ বা দ্রবণ কি না।

কাজ: অসমসত্ব মিশ্রণকে জানা।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১টি বাটি, মুড়ি, চানাচুর, পেঁয়াজ কুচি, মরিচ কুচি ও টমেটো কুচি।
পদ্ধতি: তোমরা উপরের উপকরণগুলো মিশিয়ে ঝালমুড়ি বানাও। এবার ঝালমুড়িকে কয়েক ভাগে ভাগ কর।

তোমরা কি এই মিশ্রণের উপাদানগুলোকে সহজে আলাদা করতে পারছ? হ্যাঁ, খুব সহজেই একটি উপাদান থেকে অন্যটি আলাদা করা যাচ্ছে। সব ভাগে কি সকল উপকরণ সমানভাবে আছে? না, নেই। কোনো ভাগে মুড়ি হয়তো একটু বেশি, কোনোটাতে বা পেঁয়াজ একটু বেশি আবার কোনোটাতে হয়তো চানাচুর একটু কম বা বেশি। অর্থাৎ উপাদানগুলো সুষমভাবে বন্টিত নেই। ঝালমুড়ির মতো যে সকল মিশ্রণে উপাদানসমূহ সুষমভাবে বণ্টিত থাকে না এবং একটি থেকে অন্যটি সহজেই আলাদা করা যায়। তাদেরকে অসমসত্ত্ব মিশ্রণ বলা হয়।
এখন তোমরা পানিতে গুঁড়োদুধ, মাটি, আটা, চকের গুঁড়া, ট্যালকম পাউডার যোগ করে দেখ প্রাপ্ত মিশ্রণগুলো অসমসত্ব মিশ্রণ কিনা।

Content added By

দ্রব ও দ্রাবক (পাঠ ৩-৪)

4.1k

তোমরা বলতো চিনির শরবতে চিনি ও পানির মধ্যে কোনটি বেশি এবং কোনটি কম থাকে? নিঃসন্দেহে পানির পরিমাণ বেশি আর চিনির পরিমাণ কম থাকে। এখানে পানি চিনিকে দ্রবীভূত করেছে আর চিনি পানিতে দ্রবীভূত হয়েছে। দ্রবণে সাধারণত যেটি বেশি পরিমাণে থাকে অর্থাৎ দ্রবীভূত করে, তাকে বলে দ্রাবক আর যেটি কম পরিমাণে থাকে অর্থাৎ দ্রবীভূত হয় তাকে বলে দ্রব। তাহলে বলা যায় যে,

দ্রবণ = দ্রব + দ্রাবক

চিনির শরবতে দ্রাবক হলো পানি আর দ্রব হলো চিনি।

জলীয় দ্রবণ

উপরে দেওয়া চিনির শরবতের মতো জলীয় দ্রবণে পানি দ্রাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সকল দ্রবণের ক্ষেত্রেই দ্রাবক যে পানি হবে তা কিন্তু নয়। পানি ছাড়াও বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক বস্তু যেমন এসিটোন, স্পিরিট, ইথারও দ্রাবক হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে।

দ্রবণের ঘনমাত্রা: পাতলা ও ঘন দ্রবণ

দ্রবণে দ্রব ও দ্রাবকের পরিমাণ কম-বেশি করে ভিন্ন ভিন্ন ঘনমাত্রার দ্রবণ তৈরি করা যায়। ঘনমাত্রার উপর নির্ভর করে দ্রবণকে পাতলা বা ঘন বলা হয়। এবার তাহলে ভিন্ন ভিন্ন ঘনমাত্রার দ্রবণ তৈরি করা যাক।

কাজ: ঘন ও পাতলা দ্রবণ তৈরি ও পার্থক্যকরণ। প্রয়োজনীয় উপকরণ: দুটি কাচের গ্লাস, মাপচোঙ, চামচ, চিনি ও পানি।
পদ্ধতি: কাচের গ্লাস দুটি ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নাও। প্রতিটি গ্লাসে মাপচোঙ দিয়ে মেপে ১০০ মিলিলিটার করে খাওয়ার পানি নাও। একটি গ্লাসে ১ চামচ ও অপরটিতে ৩ চামচ চিনি দিয়ে ভালো করে নাড়া দাও। এবার উভয় গ্লাস থেকে ১ চামচ করে দ্রবণ বা শরবত নিয়ে খেয়ে এদের মিষ্টতা পরীক্ষা কর।
(বি.দ্র: বেশিরভাগ রাসায়নিক পদার্থই মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তাই কোন দ্রবণ বা রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে পুরোপুরি জানা না থাকলে এটি খেরে স্বাদ পরীক্ষা করা কোনো মতেই উচিত নয়)।

যে গ্লাসে ৩ চামচ চিনি দেওয়া হয়েছে, সেটি বেশি মিষ্টি লাগছে। চিনির শরবতের মতো সমান আয়তনের দ্রবণের ক্ষেত্রে যেটিতে দ্রবের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, সেটি ঘন দ্রবণ আর যেটিতে তুলনামূলকভাবে দ্রবের পরিমাণ কম থাকে, সেটি হলো পাতলা দ্রবণ।

আবার যদি এমন হয় যে, দুটি শরবতে চিনির পরিমাণ একই রেখে (যেমন: ১ চামচ) ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ পানি নেওয়া হয় তবে যেটিতে পানির পরিমাণ কম থাকবে সেটি বেশি মিষ্টি হবে অর্থাৎ এটিকে আমরা ঘন দ্রবণ বলতে পারি। আর যেটিতে পানির পরিমাণ বেশি থাকবে, সেটি কম মিষ্টি হবে অর্থাৎ সেটিকে আমরা পাতলা দ্রবণ বলতে পারি।
বর্ণহীন জলীয় দ্রবণ দেখে এটি পাতলা না ঘন তা বুঝার উপায় নেই। তবে রঙিন দ্রবণের ক্ষেত্রে ভিন্ন ঘনমাত্রার দ্রবণসমূহ কোনটি পাতলা, কোনটি ঘন তা বোঝা যায়, ঠিক যেমন করে আমরা পাতলা ডাল ও ঘন ডালের পার্থক্য করতে পারি (উল্লেখ্য, ডাল কিন্তু দ্রবণ নয়, একটি অসমসত্ত্ব মিশ্রণ)। এখন আমরা দেখব কীভাবে ঘন ও পাতলা রঙিন দ্রবণের পার্থক্য করা যায়।

কাজ: ভিন্ন ভিন্ন ঘনমাত্রার রঙিন জলীয় দ্রবণ তৈরি করে তা থেকে ঘন ও পাতলা দ্রবণের পার্থক্যকরণ। প্রয়োজনীয় উপকরণ: তিনটি টেস্ট টিউব, টেস্টটিউব ধারক, মাপচোঙ, চামচ, তুঁতে ও পানি।

পদ্ধতি: তিনটি পরিষ্কার টেস্টটিউব নাও। এবার টেস্টটিউবগুলোকে টেস্টটিউব-ধারকে পরপর সাজিয়ে রাখ। প্রতিটি টেস্টটিউবে মাপচোঙ দিয়ে মেপে ৫ মিলিলিটার করে পানি নাও। প্রথম টেস্টটিউবে ১ চামচ, দ্বিতীয় টেস্টটিউবে ২ চামচ ও অপরটিতে ৩ চামচ তুঁতে যোগ করে তুঁতের দানাগুলো পুরোপুরি পানিতে দ্রবীভূত না হওয়া পর্যন্ত ভালো করে ঝাঁকাও। টেস্টটিউবগুলোকে টেস্টটিউবধারকে যার যার জায়গায় আগের মতো সাজিয়ে রাখ।

তোমরা সবগুলো দ্রবণ কি সমান নীল দেখতে পাচ্ছ? না, তা নয়। যেটিতে সবচেয়ে কম পরিমাণ তুঁতে যোগ করেছ, সেটি সবচেয়ে কম নীল দেখাচ্ছে। অর্থাৎ সেটি সবচেয়ে পাতলা দ্রবণ। এভাবে তুঁতের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে দ্রবণের রং আস্তে আস্তে গাঢ় হয়েছে অর্থাৎ দ্রবণের ঘনমাত্রা পাতলা থেকে ঘন হয়েছে। একই ভাবে তোমরা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও পটাসিয়াম ডাইক্রোমেটের দ্রবণ তৈরি করে পাতলা ও ঘন দ্রবণের পার্থক্য করতে পার।

Content added By

সম্পৃক্ত দ্রবণ ও অসম্পৃক্ত দ্রবণ (পাঠ ৫-৭)

2.2k
কাজ: সম্পৃক্ত দ্রবণ ও অসম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: একটি বিকার, মাপচোঙ, নাড়ানি, লবণ ও পানি।
পদ্ধতি: বিকারটি ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নাও। বিকারে মাপচোঙ দিয়ে মেপে ১০০ মিলিলিটার পানি নাও। এবার বিকারের পানিতে অল্প অল্প করে লবণ যোগ করে নাড়তে থাক। এভাবে লবণ যোগ করতেই থাক আর নাড়তেই থাক যতক্ষণ পর্যন্ত যোগ করা লবণ অনেক নাড়লেও আর দ্রবীভূত না হয়।

ক্রমাগত লবণ যোগ করতে থাকলে একপর্যায়ে লবণ যোগ করে অনেক বেশি নাড়লেও লবণ আর দ্রবীভূত হয় না কেন? এর কারণ হলো লবণ যোগ করতে করতে দ্রবণটি সম্পৃক্ত দ্রবণে পরিণত হয়েছে, যখন দ্রাবক (পানি) আর দ্রবকে (লবণকে) দ্রবীভূত করতে পারছে না। তাহলে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের দ্রাবক সর্বোচ্চ যে পরিমাণ দ্রব দ্রবীভূত করতে পারে, সেই পরিমাণ দ্রব দ্রবীভূত থাকলে প্রাপ্ত দ্রবণকে সম্পৃক্ত দ্রবণ বলে। পক্ষান্তরে কোনো দ্রবণে যদি ঐ সর্বোচ্চ পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণের দ্রব দ্রবীভূত থাকে, তবে ঐ দ্রবণ অসম্পৃক্ত দ্রবণ হবে।

উপরের কাজে যোগকৃত লবণ অদ্রবীভূত হওয়ার আগের সকল অবস্থাকেই আমরা অসম্পৃক্ত দ্রবণ বলতে পারি। সম্পৃক্ত দ্রবণে সামান্য পরিমাণ দ্রব যোগ করে অনেক নাড়লেও দ্রব আর দ্রবীভূত হয় না, পক্ষান্তরে অসম্পৃক্ত দ্রবণে দ্রব যোগ করে নাড়া দিলে দ্রবণটি সম্পৃক্ত দ্রবণে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত দ্রব দ্রবীভূত হতেই থাকে।

দ্রবণীয়তা
তোমরা উপরের অনুচ্ছেদে সম্পৃক্ত দ্রবণ কী তা জানলে। কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম দ্রাবক নিয়ে কোনো দ্রবের সম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করতে যত গ্রাম দ্রবের প্রয়োজন হয়, তাকেই ঐ তাপমাত্রায় ঐ দ্রাবকে ঐ দ্রবের দ্রবণীয়তা বলে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ২৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম পানি সর্বোচ্চ ৩৬ গ্রাম লবণকে দ্রবীভূত করতে পারে। অর্থাৎ ২৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানিতে লবণের দ্রবণীয়তা হলো ৩৬। আবার ২৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানিতে চিনির দ্রবণীয়তা হলো ২১১.৪। অর্থাৎ ২৫° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০০ গ্রাম পানি সর্বোচ্চ ২১১.৪ গ্রাম চিনি দ্রবীভূত করতে পারে।
তরল-তরল দ্রবণ
যেসব দ্রবণে দ্রাবক হিসেবে তরল পদার্থ আর দ্রব হিসেবে কঠিন পদার্থ ব্যবহৃত হয়, সেগুলো হলো তরল- কঠিন দ্রবণ। যদি এমন হয় যে, দ্রব ও দ্রাবক উভয়ই তরল পদার্থ তাহলে ঐ দ্রবণকে তরল-তরল দ্রবণ বলা হয়। আমরা এক গ্লাস পানি নিয়ে তাতে যদি এক চামচ লেবুর রস যোগ করে ভালোভাবে নাড়া দিই, তাহলেই একটি তরল-তরল দ্রবণ পাওয়া যাবে। একইভাবে ভিনেগার বা এসিটিক অ্যাসিড ও পানি দিয়েও তরল-তরল দ্রবণ তৈরি করা যায়।

তরল-গ্যাস দ্রবণ
এবার আমরা কিছু দ্রবণ দেখি, যেখানে দ্রাবক হলো তরল পদার্থ আর দ্রব হলো গ্যাসীয় পদার্থ। কোমল পানীয় যেমন: কোকা কোলা, সেভেন আপ আমরা সবাই চিনি। এ সমস্ত কোমল পানীয়ের বোতল খোলার সাথে সাথে হিস্ শব্দ করে বুদবুদ আকারে গ্যাসীয় পদার্থ বের হয়। এ গ্যাসীয় পদার্থটি হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড যা পানীয়ের মধ্যে দ্রবীভূত অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ কোমল পানীয়গুলোকে আমরা তরল-গ্যাস দ্রবণ বলতে পারি।
তোমরা কি জান পানিতে বসবাসকারী প্রাণীসমূহ (যেমন: মাছ) তাদের নিঃশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কোথা থেকে পায়? তারা তো আমাদের মতো সরাসরি বাতাস থেকে অক্সিজেন নিতে পারে না। পানিতে বসবাসকারী প্রাণীসমূহ অক্সিজেন নেয় পানিতে থাকা দ্রবীভূত অক্সিজেন থেকে। তাহলে নদ-নদী, খাল বিল বা প্রাকৃতিক জলাশয়ের পানি কিন্তু এক ধরনের তরল-গ্যাস দ্রবণ। এই সমস্ত প্রাকৃতিক পানিতে অক্সিজেন ছাড়াও অন্যান্য অনেক কিছুই দ্রবীভূত থাকে।
আবার ইদানীং বহুল সমালোচিত ফরমালিনও (যা আইনবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন ফল ও মাছের সংরক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে) পানিতে ফরমালডিহাইড নামক গ্যাসের দ্রবণ।

দ্রবণে তাপের প্রভাব

কাজ: দ্রবণে তাপের প্রভাব পর্যবেক্ষণ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: একটি বিকার, নাড়ানি, ত্রিপদি স্ট্যান্ড, তারজালি, একটি নিক্তি, লবণ, পানি ও স্পিরিট ল্যাম্প।


পদ্ধতি: একটি পরিষ্কার বিকারে ১০০ গ্রাম পানি নিক্তি দিয়ে মেপে নাও। ধীরে ধীরে লবণ যোগ করে নাড়তে থাক। যোগকৃত লবণ যদি আর দ্রবীভূত না হয়, তাহলে লবণ যোগ করা বন্ধ কর। এবার ত্রিপদি স্ট্যান্ডের উপর তারজালি রেখে তার উপর বিকারটিকে বসাও এবং স্পিরিট ল্যাম্প দিয়ে বিকারের তলায় তাপ দিতে থাক ও নাড়তে থাক।

তাপ দেওয়ার পর দ্রবণটিতে কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে? হ্যাঁ, আস্তে আস্তে অদ্রবীভূত লবণের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। এভাবে আরও কিছুক্ষণ তাপ দিতে থাকলে সম্পূর্ণ লবণই দ্রবীভূত হয়ে যাবে। তাহলে এটি বলা যায় যে, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে পানিতে লবণের দ্রবণীয়তা বেড়েছে আর সে কারণেই অদ্রবীভূত লবণ তাপ দেয়ার পরে দ্রবীভূত হয়েছে। তবে কিছু কিছু দ্রবণের ক্ষেত্রে (যেমন: পানিতে সিরিয়াম সালফেট ও ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড) তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রবণীয়তা কমে যায়।

Content added By

সর্বজনীন দ্রাবক (পাঠ ৮-৯)

439

দ্রবণে দ্রাবক সম্পর্কে তোমরা আগেই জেনেছ। সর্বজনীন দ্রাবক বলতে কী বুঝায়? এটি হবে এমন দ্রাবক, যা সব রকমের পদার্থকে দ্রবীভূত করতে পারবে। এরকম কোন দ্রাবক কি বাস্তবে পাওয়া সম্ভব? সম্ভবত নয়। তবে অনেক রকমের পদার্থকে দ্রবীভূত করতে পারে এমন একমাত্র দ্রাবক হচ্ছে আমাদের অতি পরিচিত পানি। অর্থাৎ পানিই হচ্ছে এখন পর্যন্ত পাওয়া একমাত্র সর্বজনীন দ্রাবক। পানি একদিকে যেমন অসংখ্য অজৈব পদার্থকে (ক্যালসিয়াম কার্বনেট, সিলিকা ইত্যাদি ছাড়া) দ্রবীভূত করতে পারে, তেমনি অন্যদিকে অনেক জৈব যৌগ (যেমন স্পিরিট, এসিটোন, এসিটিক অ্যাসিড) ও গ্যাসীয় পদার্থকেও দ্রবীভূত করতে পারে।
হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন নানারকম জৈব ও অজৈব পদার্থ নিয়ে তোমরা পানিতে এদের দ্রবণীয়তা পরীক্ষা করে দেখ।

সমসত্ব মিশ্রণ প্রস্তুত ও পৃথকীকরণ
এই অধ্যায়ের শুরুতে আমরা সমসত্ব মিশ্রণের কিছু উদাহরণ দেখেছি। এখন দেখব কীভাবে এ সকল মিশ্রণ প্রস্তুত ও তাদের উপাদানসমূহকে পৃথক করা যায়।

কাজ: সমসত্ব মিশ্রণ প্রস্তুতকরণ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: একটি বিকার, চামচ, নাড়ানি, গ্লুকোজ ও পানি, চারটি ওয়াচ গ্লাস বা কাচের ছোটো পাত্র পদ্ধতি: বিকারটি ভালো করে পরিষ্কার করে তাতে ২০০ মিলিলিটার (ভিন্ন পরিমাণও নেওয়া যেতে পারে) পানি মাপচোঙ দিয়ে মেপে নাও। এবার ৪-৫ চামচ গ্লুকোজ বিকারের পানিতে যোগ করে ভালোভাবে নাড়া দাও। গ্লুকোজ ও পানির মিশ্রণটি সমসত্ব হয়েছে কি না সেটি পরীক্ষা করে দেখা যাক। পুরো মিশ্রণটিকে সমান চার ভাগে ভাগ কর ও চারটি ওয়াচ গ্লাসে রাখ। প্রতিটি ওয়াচ গ্লাসের আলাদা আলাদা ভর মেপে নাও ও লিখে রাখ। এবার প্রতিটি ওয়াচ গ্লাস ত্রিপদি স্ট্যান্ডের উপর রাখা তারজালির উপর বসিয়ে স্পিরিট ল্যাম্পের সাহায্যে তাপ দিয়ে পানি পুরোপুরি শুকিয়ে ফেল। ওয়াচ গ্লাসগুলোকে ঠান্ডা করে প্রতিটির ভর মেপে নাও। প্রতিটি ওয়াচ গ্লাসের পরের ভর ও আগের ভরের পার্থক্য থেকে প্রাপ্ত গ্লুকোজের ভর হিসেব কর।

দ্রবণে গ্লুকোজের কণাগুলোকে আর দেখতে পাচ্ছ কি? না, মোটেও না। কারণ গ্লুকোজের দানাগুলো সম্পূর্ণরূপে পানিতে দ্রবীভূত হয়ে গেছে। এবার পানি শুকানোর পর তোমরা প্রতিটি পাত্রে সমান পরিমাণ গ্লুকোজ পেয়েছ কি? হ্যাঁ, প্রতিটি পাত্রে পাওয়া গ্লুকোজের পরিমাণ সমান। অতএব বলা যায় যে পানি ও গ্লুকোজের মিশ্রণটি সমসত্ব ছিল। তা না হলে কোনো ভাগে গ্লুকোজ বেশি আবার কোনোটাতে কম পাওয়া যেত।
যে প্রক্রিয়ায় তাপ দিয়ে পানি শুকিয়ে ফেললে তার নাম জান কি? এটি হলো বাষ্পীভবন। অর্থাৎ তাপ দিয়ে তরল পদার্থকে বাষ্পে পরিণত করার প্রক্রিয়াকেই বাষ্পীভবন বলে। তোমাদের কি মনে হয় বাষ্পীভবন ছাড়া আর কোনো সহজ পদ্ধতিতে গ্লুকোজকে পানি থেকে আলাদা করা যাবে? না, এটিই একমাত্র উপায়, যা বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ।

অসমসত্ব মিশ্রণ প্রস্তুত ও পৃথকীকরণ

কাজ: অপরিষ্কার লবণ ও পানির অসমসত্ব মিশ্রণ প্রস্তুতকরণ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: একটি বিকার বা কাচের গ্লাস, চামচ, নাড়ানি, অপরিষ্কার লবণ ও পানি।
পদ্ধতি: বিকার বা কাচের গ্লাসটি ভালো করে পরিষ্কার করে তাতে ২০০ মিলিলিটার (ভিন্ন পরিমাণও নেওয়া যেতে পারে) পানি নাও। এবার ১-২ চামচ অপরিষ্কার লবণ বিকারের পানিতে যোগ করে ভালোভাবে নাড়া দাও। মিশ্রণটিকে কিছুক্ষণ রেখে দাও।

কী দেখতে পাচ্ছ? লবণের কণাগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে গেছে আর ময়লার ভারি কণাগুলো বিকারের তলায় জমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে ময়লার হালকা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাগুলো পানিতে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। ময়লার কণাগুলো পানিতে সুষমভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে না অর্থাৎ এটি নিশ্চিত যে মিশ্রণটি লবণ-পানি- ময়লার একটি অসমসত্ব মিশ্রণ।
ময়লার কণাগুলো যে সুষমভাবে বিন্যস্ত নয় সেটি কীভাবে পরীক্ষা করে প্রমাণ করা যায়? আগের কাজের মতো সমান কয়েক ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগ থেকে পানি পুরোপরি বাষ্পায়িত করে প্রতি ভাগে অবশিষ্ট বস্তুর ভর পরিমাপ করলেই দেখা যাবে একেক ভাগে একেক পরিমাণ বস্তু রয়েছে।

বলতো এই মিশ্রণ থেকে আমরা কি কোনোভাবে অদ্রবণীয় মরলার কণা দূর করতে পারি? ছাঁকুনি দিয়ে চাপাতা যেভাবে লিকার থেকে আলাদা করা হয়, ঠিক একইভাবে আমরা অদ্রবণীয় বস্তুর কণাগুলোকেও মিশ্রণ থেকে আলাদা করতে পারি। এবার দেখে নিই কীভাবে ফিল্টার কাগজ দিয়ে ময়লার কণাগুলো লবণ পানি থেকে আলাদা করে পরিষ্কার লবণ পাওয়া যায়।

কাজ: অপরিষ্কার লবণ হতে পরিষ্কার লবণ প্রস্তুতকরণ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: অপরিষ্কার লবণের অসমসত্ত্ব মিশ্রণ, নাড়ানি, ত্রিপদি স্ট্যান্ড, তারজালি, ফানেল, ফিল্টার কাগজ, রিংযুক্ত স্ট্যান্ড ও পানি।
পদ্ধতি: একটি ফিল্টার কাগজ নিয়ে প্রথমে সমান চার ভাঁজ কর। এরপর চিত্রের মতো করে একদিকে তিন ভাঁজ ও অন্যদিকে এক ভাঁজ রেখে ফানেলের ভিতরে বসিয়ে দাও। ফিল্টার কাগজটিকে পরিষ্কার পানি দিয়ে অল্প করে ভিজিয়ে নাও যাতে এটি সরে না যায়। ফানেলটি চিত্র অনুযায়ী স্ট্যান্ডের সাথে যুক্ত রিংয়ের উপর বসাও। ফানেলের নিচে একটি বিকার রাখ। অতঃপর আগের কাজের অপরিষ্কার লবণের অসমসত্ব মিশ্রণটি ফিল্টার পেপারের উপর আস্তে আস্তে ঢেলে দাও। যতক্ষণ পর্যন্ত ফানেল থেকে পরিষ্কার পানি পড়া শেষ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা কর। এবার পরিষ্কার লবণ-পানির বিকারটিকে ত্রিপদি স্ট্যান্ডের উপর রাখা তারজালির উপর বসিয়ে স্পিরিট ল্যাম্পের সাহায্যে তাপ দিয়ে সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে ফেল।

মিশ্রণটি ফানেলে ঢালার পর কী ঘটল? মাটির কণামুক্ত পরিষ্কার লবণ-পানি ধীরে ধীরে ফিল্টার কাগজের মধ্য দিয়ে নিচে রাখা বিকারে জমা হলো আর মাটির কণাগুলো ফিল্টার কাগজের উপরে আটকে রইল। মাটির কণাগুলোকে ফিল্টার কাগজ দিয়ে মাটি ও পানির মিশ্রণ থেকে আলাদা করার এই প্রক্রিয়ার নাম হলো পরিস্রাবণ অর্থাৎ পরিস্রাবণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তরল ও কঠিন পদার্থের মিশ্রণ থেকে কঠিন পদার্থকে আলাদা করা যায়।
বিকারের পানি পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার পর তোমরা কী পেলে? সাদা ধবধবে ও পরিষ্কার লবণের স্তর পেয়েছ। কারণ শুরুতে নেওয়া ময়লাযুক্ত লবণ থেকে সকল ময়লা ফিল্টার কাগজ দিয়ে পরিস্রাবণের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে দূর করা হয়েছে। মনে রেখো ময়লার মধ্যে যদি পানিতে দ্রবণীয় কোন অংশ থাকে তাহলে উপরোক্ত পদ্ধতিতে সেই অংশকে লবণ থেকে আলাদা করা যাবে না।

Content added By

লবণাক্ত পানি হতে লবণের স্ফটিক প্রস্তুতকরণ (পাঠ ১০-১২)

1.3k

আমরা পূর্বের অনুচ্ছেদে পরিস্রাবণ ও বাষ্পীভবনের মাধ্যমে পরিষ্কার লবণ প্রস্তুত প্রণালি দেখেছি। ঐ প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত লবণ কিন্তু দানাদার ছিল না, ছিল লবণের স্তর যা মূলত অদানাদার লবণ। এখন আমরা লবণাক্ত পানি হতে দানাদার লবণ অর্থাৎ লবণের স্ফটিক প্রস্তুতকরণের কৌশল দেখব।

কাজ: লবণাক্ত পানি হতে লবণের স্ফটিক প্রস্তুতকরণ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ ১টি বিকার, চামচ, নাড়ানি, ত্রিপদি স্ট্যান্ড, তারজালি, ফানেল, ফিল্টার কাগজ, রিং যুক্ত স্ট্যান্ড, কিছু অপরিষ্কার লবণ ও পানি।
পদ্ধতি: একটি বিকারে ২০০ মিলিলিটার পানি ও ৫০ গ্রাম অপরিষ্কার লবণের একটি মিশ্রণ তৈরি করে পরিস্রাবণের মাধ্যমে পরিষ্কার লবণ-পানির দ্রবণ অর্থাৎ লবণাক্ত পানি বানাও। এবার লবণাক্ত পানি একটি বিকারে নিয়ে বিকারকে ত্রিপদি স্ট্যান্ডের উপর রাখা তারজালির উপর বসিয়ে তাপ দিতে থাক। তাপ দিতে দিতে বিকারে লবণাক্ত পানির আরতন প্রায় অর্ধেকে পরিণত হলে তাপ দেওয়া বন্ধ কর। অতঃপর বিকারে একটি ঢাকনা দিয়ে ঠাণ্ডা করার জন্য রেখে দাও।

বিকারটি ঠাণ্ডা হওয়ার পরে তোমরা কি কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছ? বিকারের তলায় বা গায়ে লবণের দানা জমা হতে শুরু করেছে। এই দানাযুক্ত লবণই হলো লবণের স্ফটিক। লবণের স্ফটিক তৈরির এই পদ্ধতিকে বলা হয় স্ফটিকীকরণ। অনেক সময় লবণাক্ত পানি হতে স্ফটিক পাওয়ার জন্য এতে দুই একটি লবণের দানা বাইরে থেকে যোগ করতে হয়। এতে যোগকৃত লবণ দানাকে ঘিরে খুব দ্রুত দানাদার লবণ জমা হতে থাকে।

লবণাক্ত পানি হতে বিশুদ্ধ পানি প্রস্তুতকরণ

লবণাক্ত পানি অথবা যেকোনো মিশ্রণ হতে বিশুদ্ধ পানি প্রস্তুত করার একটি সহজ উপায় হচ্ছে পাতন পদ্ধতি, যার জন্য প্রয়োজন একটি পাতন যন্ত্র। চিত্র-৮.৬ এ একটি পাতন যন্ত্র দেখানো হলো:

পাতন যন্ত্রটির বাম পাশে রয়েছে পরীক্ষাধীন লবণাক্ত পানি নেওয়ার জন্য একটি গোলতলী ফ্লাস্ক (১)। এর সাথে সংযুক্ত আছে একটি শীতক (condenser) (২) যার ভিতরে একটি সরু কাচের নল (৩) বসানো আছে এবং ঐ নলের চারপাশে ঠান্ডা পানির প্রবাহের জন্য একটি প্রবেশ নল (৪) ও একটি নির্গমন নল (৫) আছে। আর ডান পাশে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করার জন্য আছে আরেকটি গ্রাহক ফ্লাস্ক (৬)। এছাড়া পানিতে তাপ দেওয়ার জন্য একটি বৈদ্যুতিক হিটার (৭) আর তাপমাত্রা মাপার জন্য বাম পাশের ফ্লাস্কের উপরে থার্মোমিটার (৮) বসানোর জন্য ও শীতকের সাথে যুক্ত করার জন্য একটি কাচের এডাপটার (৯) রয়েছে। এছাড়া ফ্লাস্ক দুটি ও শীতককে সঠিকভাবে ধরে রাখার জন্য স্ট্যান্ড (১০) ও ক্ল্যাম্প (১১) রয়েছে। এবার দেখা যাক পাতন যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করে।

কাজ: লবণাক্ত পানি হতে বিশুদ্ধ পানি প্রস্তুতকরণ।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১টি পাতন যন্ত্র, ৫০০ মিলিলিটার লবণাক্ত পানি।
পদ্ধতি: চিত্র ৮.৬ এর মতো করে পাতন যন্ত্রটি সাজিয়ে গোলতলী ফ্লাস্ক (১) এ লবণাক্ত পানি নাও। পাতন যন্ত্রটির পানি প্রবেশের নলটি (৪) একটি পানির ট্যাপের সাথে সংযুক্ত করে পানির প্রবাহ চালু কর। পানি নির্গমণের নলের সাথে একটি প্লাস্টিকের পাইপ যুক্ত করে বেসিনে রাখ। এবার বৈদ্যুতিক হিটার দিয়ে ফ্লাস্কে তাপ দিতে থাক। বৈদ্যুতিক হিটারের ব্যবস্থা না থাকলে স্পিরিট ল্যাম্প বা অন্য যেকোনো উপায়ে তাপ দেওয়া যেতে পারে। পাতন যন্ত্রের থার্মোমিটারে তাপমাত্রা খেয়াল কর। বাষ্পীভূত পানি শীতকের সরু নলের মধ্য দিয়ে গ্রাহক ফ্লাস্কে (৬) জমা হতে শুরু করলে অপেক্ষা করতে থাক। গোলতলী ফ্লাস্ক (১) এ পানির পরিমাণ তিন-চতুর্থাংশ কমে গেলে তাপ দেয়া বন্ধ কর।

তাপ দেয়ার পর কী ঘটে? থার্মোমিটারের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পানি ফুটতে শুরু করে ও বাষ্পে পরিণত হয়। উক্ত বাষ্প শীতকে প্রবেশ করলে ঠাণ্ডা হয়ে তা তরলে পরিণত হয়। বাষ্প তরলে পরিণত হওয়ার এ প্রক্রিয়াকে ঘনীভবন বলে। ঘনীভূত পানি ফোঁটায় ফোঁটায় গ্রাহক ফ্লাস্কে জমা হতে থাকে। এই জমা হওয়া পানিই বিশুদ্ধ পানি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পানির কোনো মিশ্রণ থেকে বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে আমাদের দুটি প্রক্রিয়া প্রয়োগ করতে হয়। এদের একটি হলো বাস্পীভবন আর অন্যটি ঘনীভবন। তোমরা কি এখন সমুদ্রের পানি থেকে বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে পারবে?

সাসপেনসন ও কলয়েড

কাজ: সাসপেনসন তৈরি।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১টি কাচের গ্লাস, চামচ, কাদামাটি ও পানি।
পদ্ধতি: কাচের গ্লাসের তিন-চতুর্থাংশ ভরে পানি নাও। ১ চামচ পরিমাণ কাদামাটি গ্লাসে যোগ করে খুব ভালোভাবে নাড়া দাও। মিশ্রণটিকে কিছুক্ষণের জন্য রেখে দাও।

কী দেখতে পাচ্ছ? প্রথমে পুরো মিশ্রণটি ঘোলা দেখাচ্ছে। রেখে দেওয়ার পর তুলনামূলকভাবে ভারি মাটির কণাগুলো গ্লাসের তলায় জমা হচ্ছে, তবে কিছু কিছু মাটির কণা যেগুলো খুব হাল্কা ও ছোটো ছোটো তারা পানিতে ভাসমান অবস্থায়ই থাকছে আর মিশ্রণটি অল্প ঘোলাটে দেখাচ্ছে। আরও কিছু সময় মিশ্রণটি কোনো নাড়াচড়া না করলে, মিশ্রণটিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছ কি? হ্যাঁ, মাটির আরও কিছু ক্ষুদ্র কণা তলায় জমা পড়ছে তবে পানি পুরোপুরি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, কারণ কিছু কিছু ক্ষুদ্র কণা তখনও পানিতে ভাসমান অবস্থায় থেকেই যাচ্ছে। মাটি ও পানির এ জাতীয় মিশ্রণ যা রেখে দিলে উপাদানসমূহ আংশিক আলাদা হয়ে যায় তাকেই সাসপেনসন বলে। একইভাবে, চক মিহি করে গুঁড়া করে বা আটা পানিতে যোগ করে ভালোভাবে নাড়া দিলে যে মিশ্রণ পাওয়া যায় সেগুলোও সাসপেনসন। আমরা বাড়িতে যে সকল এন্টিবায়োটিক বা এন্টাসিডের সাসপেনসন ব্যবহার করি, সেগুলোও রেখে দিলে আংশিক আলাদা হয়ে যায় ও ঔষধের বোতলের নিচে তলানি পড়ে যায়। তাই ঔষধ সেবনের পূর্বে বোতল ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিতে হয়।
এবার তোমরা দ্রবণ, সাসপেনসন ও অসমস্বত্ব মিশ্রণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছ কি? অসমস্বত্ব মিশ্রণে উপকরণগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায় ও আলাদা করা যায়। সাসপেনসনের ক্ষেত্রে উপকরণগুলো চিহ্নিত করা গেলেও সহজে আলাদা করা যায় না আর দ্রবণের ক্ষেত্রে উপকরণগুলো চিহ্নিতও করা যায় না, সহজে আলাদাও করা যায় না।

এবার আসা যাক কলয়েডের কথায়। সাসপেনসনের বেলায় আমরা দেখলাম, একটি উপকরণের ছোটো ছোটো কণাগুলো ভাসমান অবস্থায় থাকে কিন্তু অনেকক্ষণ রেখে দিলে তা তলানি হিসেবে জমা পড়ে। কিন্তু এমন কি হতে পারে না যে, কণাগুলো এতই ক্ষুদ্র ও হাল্কা যে তারা কখনই পাত্রের তলায় জমা হতে পারবে না, সব সময়ই ভাসমান বা সাসপেন্ডেড অবস্থায়ই থাকবে? হ্যাঁ অবশ্যই পারে, আর সে ধরনের মিশ্রণ যেখানে অতি ক্ষুদ্র কোনো বস্তুকণা অপর বস্তুকণার মাঝে সাসপেন্ডেড বা ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং রেখে দিলে কখনই কোনো তলানি পড়ে না তাকে বলা হয় কলয়েড।
কলয়েডে বিদ্যমান উপাদানগুলো একটি আরেকটিতে দ্রবীভূত হয় না, কিন্তু ছড়িয়ে থাকে। কলয়েডে যেটি প্রধান উপদান বা পরিমাণে বেশি থাকে, তাকে বলে অবিচ্ছিন্ন ফেজ বা দশা আর যেটি কম পরিমাণে থাকে বা ছড়িয়ে থাকে, তাকে বলে ডিসপারসড ফেজ বা দশা। যেমন: দুধ হচ্ছে একটি কলয়েড, যা পানি ও চর্বি দিয়ে তৈরি। চর্বির ক্ষুদ্র কণাগুলো পানিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, যা খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে ঠিকই দেখা যায়। চিত্র-৮.৭ এ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পাওয়া দুধের একটি ছবি দেখানো হলো।

দুধের মতো কুয়াশা হচ্ছে আরেকটি কলয়েড, যেখানে পানির ছোটো ছোটো কণাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে থাকে। আবার আমাদের অতি পরিচিত অ্যারোসলও কিন্তু এক ধরনের কলয়েড, যেখানে তরল কীটনাশকের কণাগুলো বাতাসে ভেসে থাকে। এখন প্রশ্ন হতে পারে যে কলয়েড তৈরির জন্য ভাসমান ক্ষুদ্র কণাগুলোর আকার কত ছোট হতে হবে? সাধারণত কলয়েডে বিদ্যমান ভাসমান কণাগুলোর আকার ১-১০০০ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে। আর যদি কণাগুলোর আকার ১ মাইক্রোমিটার বা তার বেশি হয়, তখন এটি আর কলয়েড না হয়ে সাসপেনসনে পরিণত হয়।

এই অধ্যায়ে আমরা যা শিখলাম
• একের অধিক বিশুদ্ধ পদার্থ মিশালে মিশ্রণ তৈরি হয়।
• দ্রবণসমূহ এক বিশেষ ধরনের মিশ্রণ, যেখানে দ্রব দ্রাবকে সুষমভাবে বিন্যস্ত থাকে ও একটিকে অপরটি থেকে খুব সহজে আলাদা করা যায় না।
• অসমসত্ত্ব মিশ্রণে উপাদানগুলি মিশ্রণের সর্বত্র সুষমভাবে বিন্যস্ত থাকে না এবং একটিকে অপরটি থেকে খুব সহজে আলাদা করা যায়।
• দ্রবণে যে উপাদানটি বেশি পরিমাণে থাকে ও দ্রবীভূত করে সেটি হলো দ্রাবক আর যে উপাদানটি কম পরিমাণে থাকে ও দ্রবীভূত হয় সেটি হলো দ্রব।
• সমপরিমাণ দুটি দ্রবণের মধ্যে যেটিতে দ্রবের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে তার ঘনমাত্রা বেশি হয়। সম্পৃক্ত দ্রবণে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের দ্রাবক সর্বোচ্চ যে পরিমাণ দ্রব দ্রবীভূত করতে পারে, সেই পরিমাণ দ্রব দ্রবীভূত থাকে।
• ১০০ গ্রাম দ্রাবকে কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি দ্রবের সম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করতে যতটুকু দ্রবের প্রয়োজন হয়, তাকেই ঐ তাপমাত্রায় ঐ দ্রাবকে ঐ দ্রবের দ্রবণীয়তা বলে।
• তাপ দিলে কোনো কোনো দ্রবের দ্রবণীয়তা বাড়ে আবার কোনো কোনো দ্রবের দ্রবণীয়তা কমে।
• পরিস্রাবণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে তরল ও কঠিন পদার্থের অসমস্বত্ব মিশ্রণ থেকে উপাদানসমূহকে আলাদা করা যায়।
• তাপের প্রভাবে তরল পদার্থকে বাষ্পে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে বাষ্পীভবন বলা হয়।
• ঘনীভবন হলো বাষ্পকে শীতল করে তরলে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া।
• সাসপেনসন হলো এমন একটি মিশ্রণ, যা রেখে দিলে উপাদানসমূহ আংশিকভাবে আলাদা হয়ে যায়।
• কলয়েড এক ধরনের মিশ্রণ, যেখানে একটি উপাদানের ক্ষুদ্র কণা অন্য উপাদানে ছড়িয়ে থাকে।

Content added By
Promotion
NEW SATT AI এখন আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

Are you sure to start over?

Loading...